অণুস্তরের তরঙ্গ আবিষ্কার: নোবেল বিজয়ী এক বিপ্লব
অণুস্তরের তরঙ্গ শনাক্তকরণ
অণুস্তরের তরঙ্গ হলো মহাকাশ ও কালের নিরবচ্ছিন্নতার এক ধরনের কম্পন, যা এক শতাব্দীরও বেশি আগে আলবার্ট আইনস্টাইন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এই তরঙ্গগুলো সৃষ্টি হয় বিশাল ভরের বস্তু, যেমন ব্ল্যাক হোল এবং নিউট্রন তারা, গতিশীল হওয়ার ফলে।
2015 সালে, লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি (এলআইজিও), একটি বিশাল যন্ত্র যা অণুস্তরের তরঙ্গ শনাক্ত করার জন্য তৈরি, প্রথমবারের মত এই ধরনের কম্পন সরাসরি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। এই আবিষ্কারটি একটি বিরাট বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ছিল, কারণ এটি আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের অন্যতম মূল ভিত্তিকে নিশ্চিত করেছে।
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার
অণুস্তরের তরঙ্গ আবিষ্কারের কাজে অসামান্য অবদানের জন্য, 2017 সালে তিনজন মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানীকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়ঃ
- ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির রেইনার ওয়েইস
- ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির কিপ এস. থর্ন
- ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ব্যারি সি. ব্যারিশ
লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি (এলআইজিও)
এলআইজিও একটি জটিল যন্ত্র যা দুটি এল আকৃতির শনাক্তকারী নিয়ে গঠিত, একটি লুইজিয়ানায় অবস্থিত এবং অপরটি ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে। প্রতিটি শনাক্তকারীতে দুটি 2.5 মাইল দীর্ঘ বাহু রয়েছে যাদের প্রান্তদুটিতে অত্যন্ত প্রতিফলনকারী আয়না রয়েছে।
এলআইজিও আয়নাগুলির মধ্যে লেজার রশ্মি প্রতিফলিত হতে কত সময় নেয় তা পরিমাপ করে কাজ করে। লেজারের গতিপথে যেকোন সূক্ষ্ম পরিবর্তনই একটি অণুস্তরের তরঙ্গের অতিক্রমণের ইঙ্গিত দিতে পারে।
অণুস্তরের তরঙ্গ শনাক্তকরণের প্রভাব
অণুস্তরের তরঙ্গ শনাক্তকরণ পদার্থবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এর ফলেঃ
- আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের অন্যতম প্রধান পূর্বাভাস নিশ্চিত হয়েছে
- মহাবিশ্ব, বিশেষ করে ব্ল্যাক হোল এবং নিউট্রন তারা গবেষণার জন্য একটি নতুন সরঞ্জাম পাওয়া গেছে
- মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা, এমনকি মহাবিস্ফোরণ সম্পর্কে অণুস্তরের তরঙ্গ গবেষণার সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে
অণুস্তরের তরঙ্গ জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ
অণুস্তরের তরঙ্গ শনাক্তকরণ এখনো শুধুমাত্র শুরু। এলআইজিও এবং অন্যান্য অণুস্তরের তরঙ্গ পর্যবেক্ষণকারীরা তাদের সংবেদনশীলতা ক্রমাগতভাবে বাড়াচ্ছে, যা তাদের আরও দুর্বল অণুস্তরের তরঙ্গ শনাক্ত করতে সক্ষম করবে।
ভবিষ্যতে, অণুস্তরের তরঙ্গ জ্যোতির্বিজ্ঞান আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে বোধগম্যতার এক বিপ্লব ঘটানোর আশা করা হচ্ছে, কারণ এটি সবচেয়ে প্রান্তিক এবং রহস্যময় ঘটনাগুলি, যেমন ব্ল্যাক হোলের সংমিশ্রণ এবং মহাবিস্ফোরণ সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করবে।
আবিষ্কারে মুখ্য ব্যক্তিত্ব
কিপ থর্ন
কিপ থর্ন একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী যিনি এলআইজিওর উন্নয়নে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি প্রথম কয়েকজন বিজ্ঞানীর একজন যিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে অণুস্তরের তরঙ্গ শনাক্ত করা যায় এবং তিনি এলআইজিওর শনাক্তকারী ডিজাইন এবং তৈরিতে সহায়তা করেছিলেন।
রেইনার ওয়েইস
র্যেইনার ওয়েইস একজন পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানী যাকে এলআইজিওর প্রাথমিক ধারণার উন্নয়নের জন্য দায়ী করা হয়। তিনি সেই দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যারা 1970-এর দশকে প্রথম এলআইজিও শনাক্তকারী তৈরি করেছিল।
ব্যারি ব্যারিশ
ব্যারি ব্যারিশ একজন পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানী যিনি 1994 সালে এলআইজিওর পরিচালক হন। তাকে এই প্রকল্পটি পুনর্গঠন এবং পরিচালনা করার জন্য দায়ী করা হয়, যা সেই সময় অনেক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। তার নেতৃত্বে এলআইজিও সম্পূর্ণ হয় এবং 2015 সালে অণুস্তরের তরঙ্গের প্রথম শনাক্তকরণ ঘটে।
চ্যালেঞ্জ এবং সীমাবদ্ধতা
অণুস্তরের তরঙ্গ শনাক্তকরণ একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। তরঙ্গগুলি অত্যন্ত দুর্বল এবং অন্যান্য শোরগোল দ্বারা সহজেই আবৃত হয়ে যেতে পারে। এলআইজিও এবং অন্যান্য অণুস্তরের তরঙ্গ পর্যবেক্ষণকারীদের এই তরঙ্গগুলিকে শনাক্ত করার জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল হতে হবে।
অণুস্তরের তরঙ্গ জ্যোতির্বিজ্ঞানের আরেকটি সীমাবদ্ধতা হল এটি কেবলমাত্র নির্দিষ্ট ধরনের উৎস থেকে, যেমন ব্ল্যাক হোলের সংমিশ্রণ এবং নিউট্রন তারার সংঘর্ষ থেকে অণুস্তরের তরঙ্গ শনাক্ত করতে