পারদ: ব্যবহার ও অপব্যবহারের ঐতিহ্য
প্রাচীন সভ্যতা এবং পারদ
অনেক হাজার বছর ধরে পারদ প্রাচীন সভ্যতাকে বিমোহিত করেছে। চীন, ভারত, গ্রিস এবং রোম সহ বিভিন্ন দেশ পারদ বিভিন্নভাবে ব্যবহার করেছে। প্রাচীন চীনে, সম্রাট ইয়িং ঝ্যাংকে পারদের নদী এবং স্রোত দ্বারা বেষ্টিত মৃৎশিল্প সৈন্যদের একটি বাহিনী দিয়ে সমাহিত করা হয়েছিল। বিশ্বাস করা হয় তিনি অমরত্বের সন্ধানে এই বিষাক্ত ধাতু খাওয়ার পরে পারদের বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছিলেন।
অ্যালকেমি এবং দার্শনিকের পাথর
স্যার আইজ্যাক নিউটন সহ অ্যালকেমিস্টরা কিংবদন্তির দার্শনিকের পাথরের মাধ্যমে সীসাকে সোনায় রূপান্তরিত করার চেষ্টায় পারদের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। রোগ যেমন সিফিলিসের চিকিৎসায়ও পারদ ব্যবহৃত হত।
শিল্পের ব্যবহার এবং ম্যাড হ্যাটার
১৯ শতকে টুপি তৈরিতে পারদ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত। টুপি তৈরি করা লোকেরা পশুর চামড়া থেকে লোম আলাদা করতে পারদের নাইট্রেট ব্যবহার করত, যার ফলে লোম কমলা হয়ে যেত এবং সরানো সহজ হয়ে যেত। এই প্রক্রিয়াটিকে ক্যারোটিং হিসাবে পরিচিত, যা টুপি বানানোর লোকদের মধ্যে পারদের উচ্চ মাত্রার সংস্পর্শে নিয়ে আসে। এর ফলে “ম্যাড হ্যাটারের ডিজিজ” নামে পরিচিত একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়। ম্যাড হ্যাটারের ডিজিজের লক্ষণগুলির মধ্যে কম্পন, চঞ্চলতা এবং মানসিক অস্থিরতা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
মিনামাতা দুর্যোগ
১৯৭০ এর দশকে “মিনামাতার বিষক্রিয়া”র মাধ্যমে পারদে শিল্পীয় সংস্পর্শের প্রভাবগুলি আলোচনায় আসে। জাপানের মিনামাতা বে শহরে, একটি রাসায়নিক কারখানা থেকে পারদ বে-তে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্থানীয় মাছের জনগোষ্ঠীকে দূষিত করে ফেলে। দূষিত মাছ খাওয়া বাসিন্দাদের মধ্যে একটি মারাত্মক স্নায়ুতান্ত্রিক রোগ দেখা দেয় যা মিনামাতা রোগ নামে পরিচিত। মিনামাতা রোগের লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে হোঁচট খাওয়া, লিখতে এবং বাটন আঁটতে অসুবিধা, শ্রবণ এবং গ্রাস করার সমস্যা এবং নিয়ন্ত্রণহীন কম্পন।
আধুনিক ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণ
আজও পারদ বিভিন্ন ভোক্তা ও শিল্পজাত পণ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে ব্যাটারি, দাঁতের ফিলিং, পেইন্ট এবং প্রসাধনী। তবে পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের উদ্বেগের কারণে ধীরে ধীরে এর ব্যবহার কমানো হচ্ছে। ১৪০টি দেশ কর্তৃক স্বাক্ষরিত মিনামাতা কনভেনশন, স্বাক্ষরকারী দেশগুলিকে নির্দিষ্ট কিছু পণ্য, কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং সিমেন্ট কারখানায় পারদের ব্যবহার কমাতে מחייব করে।
পরিবেশগত প্রভাব
শিল্প প্রক্রিয়া, খনন এবং প্রাকৃতিক উৎসের মাধ্যমে পারদ পরিবেশে প্রবেশ করতে পারে। এটি বাতাস, জল এবং মাটি দূষিত করতে পারে এবং খাদ্য শৃঙ্খলে জমা হতে পারে। পারদ বিশেষত জলজ বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকারক, যেখানে খাদ্য শৃঙ্খলে এটি জৈববিকভাবে বিশাল আকার ধারণ করতে পারে এবং শিকারী মাছে উচ্চ মাত্রায় পৌঁছতে পারে।
স্বাস্থ্যের প্রভাব
পারদের সংস্পর্শের স্তর এবং সময়কালের উপর নির্ভর করে স্বাস্থ্যের উপর পারদের প্রভাবের তারতম্য হতে পারে। পারদের উচ্চ মাত্রার সঙ্গে অল্প সময়ের সংস্পর্শ বমি বমি ভাব, বমি এবং ডায়রিয়ার মতো তীব্র লক্ষণগুলির কারণ হতে পারে। পারদের নিম্ন মাত্রার সঙ্গে দীর্ঘকালীন সংস্পর্শ স্নায়বিক ক্ষতি, হৃদরোগ এবং বিকাশগত ব্যাধির কারণ হতে পারে।
উপসংহার
পারদের একটি দীর্ঘ এবং জটিল ইতিহাস রয়েছে যা ব্যবহার এবং অপব্যবহারের দ্বারা চিহ্নিত। বিভিন্ন কাজে শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও, এর বিষাক্ত বৈশিষ্ট্যগুলিও স্বীকৃত। আজ, পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের উদ্বেগের কারণে পারদের ব্যবহার ধীরে ধীরে কমানো হচ্ছে। পারদের সঙ্গে যুক্ত ঝুঁকিগুলি বোঝার মাধ্যমে আমরা নিজেদের এবং আমাদের গ্রহকে এর ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে রক্ষা করার পদক্ষেপ নিতে পারি।